একটি দেশের পুরাকীর্তি সে দেশের অতীতকালের সাক্ষ্য বহন করে। দেশটি কত উন্নত ছিল, তার কৃষ্টি, সংস্কৃতি কত উৎকর্ষতা লাভ করেছিল সে সম্পর্কে সে দেশের পুরাকীর্তি যে ছবি তুলে ধরে তার ওপর ভিত্তি করে সে দেশের সভ্যতার মান নির্ণিত হয়। এমনি একটি পুরাকীর্তির পরিচয় বহন করে আমাদের দেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়।
মহাস্থানগড় অবস্থানঃ
বগুড়া জেলার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ করতোয়া নদীর তীরে এবং ঢাকা-দিনাজপুর বিশ্বরোডের পাশে ঐতিহ্যবাহী মহাস্থানগড় অবস্থিত। সমতলভূমি থেকে এ গড়টি প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাত উঁচু হবে। প্রাচীন যুগের বহু ধ্বংসাবশেষ এখানে বিদ্যমান। বিভিন্ন সময়ে খনন করে এ-গড় থেকে পাথর, মূর্তি, শিলা, ঘরবাড়ি এবং বিভিন্ন আমলের মুদ্রা পাওয়া গেছে। মহাস্থানগড় যে পুরাকীর্তির একটি অন্যতম নিদর্শন স্থান তা সুস্পষ্টই বোঝা যায়।
মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইতিহাসঃ
অতি-প্রাচীনকালে ‘পুন্ড্ররাজ্য’ নামে এক রাজ্য ছিল। এই পুন্ড্ররাজ্যের সীমানার মধ্যে ছিল রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, বালুরঘাট, মালদহ, কুচবিহার প্রভৃতি স্থান। এ রাজ্যের এক এক সময় এক এক রকমের নামকরণ হয়েছিল; কখনও হয়েছিল বরেন্দ্রভূমি, কখনও বা গৌড়রাজ্য। উত্তর বাংলার নাম ছিল পৌন্ড্রবর্ধন। রামায়ণ মহাভারতেও পৌন্ড্রবর্ধনের নাম উল্লেখ আছে।
সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন (১0৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল । মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীল এর সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে অসেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। কারণ তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই এই দুই ভাইয়ের বিরোধের অবসান ঘটান এবং রাজা হন। এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল রাম। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম নামে পরিচিত।
শশাংক নামে এক বাঙালি রাজা একসময় পুন্ড্ররাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি মালদহ জেলার গৌড়ে প্রধান রাজধানী স্থাপন করেন। তখন পৌন্ড্রবর্ধন প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পরশুরাম নামে এক হিন্দুরাজা পৌন্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন। ইতিহাস-বিখ্যাত মহাস্থানগড় রাজা পরশুরামের আমলেই সমৃদ্ধিলাভ করে। মহাস্থানগড় ছিল করতোয়া নদীর প্রান্ত ছুঁয়ে একটি মনোরম স্থান।
এ স্থানটিকেই রাজা পরশুরাম রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত করতেন। হিজরি ৪৪০ সনে হযরত শাহ সুলতান ইব্রাহীম বলখী মাহীসওয়ার (রা.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এখানে আগমন করেন। অতঃপর ধাপ-সুলতানগঞ্জ নামক স্থানে তিনি আস্তানা স্থাপন করেন। এখানে ইসলাম প্রচারের সময় তার সংগে রাজা পরশুরাম ও তার ভগ্নী শীলাদেবীর ভীষণ যুদ্ধ হয়। (১২0৫-১২২0) যুদ্ধে রাজা পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন এবং তার বোন শীলাদেবী মন্দিরের পিছন দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে করতোয়া নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর ফলে এখানকার অগণিত লোকজন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
৪৪৭ হিজরি সনে শাহ সুলতান মাহীসওয়ার এখানে ইন্তেকাল করেন। এখানে তার মাজার রয়েছে। সুলতান সাহেবের মাজারের নীচেই তার প্রধান খাদেমের কবর রয়েছে। এখানে আর একজন দরবেশের মাজার আছে, তার নাম ছায়াতনূর। গড়ের একটু দক্ষিণে দরবেশ বোরহানউদ্দিনের মাজার। তারপর গোকূলের ম্যাড, বেহুলা সুন্দরী ও লখিন্দরের বাসরঘরের ধ্বংসাবশেষ, পশ্চিমে কালিদহ সাগর ও বাসোবনিয়া সওদাগরের বাড়ি, উজানীভাইটানী নগর। এছাড়া, উল্লেখযোগ্য স্থান হলো শীলাদেবীর ঘাট ও রাজা পরশুরামের সভাগৃহের ধ্বংসাবশেষ।
শীলাদেবীর ঘাট হিন্দুদের তীর্থস্থান। এখানে প্রতিবছর মেলা বসে এবং গঙ্গাস্নান করা হয়। পরশুরাম রাজার জীয়ৎকূপ একটি আশ্চার্য্যজনক কূপ। এ কূপের পানি দিয়ে নাকি মৃত ব্যক্তিকে বাঁচানো যেত। বস্তুত, শীলাদেবীর জন্যেই আজ মহাস্থানগড়, হিন্দুদের তীর্থস্থান এবং শাহ সুলতানের জন্যে মুসলমানদের অন্যতম পবিত্র স্থান।
বর্তমান অবস্থাঃ
মহাস্থানগড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বহু সংখ্যক প্রাচীন নিদর্শন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকে শুরু করে মুসলিম যুগের শেষ পযর্ন্ত বহু নিদর্শন প্রত্নতাত্বিকগণ খনন কাজের মাধ্যমে বের করেছেন। এসব দেখে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সত্যই মহাস্থানগড় একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান ছিল।
সুদূর অতীতের স্মৃতি বুকে ধরে মহাস্থানগড় ইতিহাসের পাতায় ঘুমিয়ে থাকলেও অনুসন্ধিৎসু মানুষ তাকে ভুলেনি। আজও বহু পযর্টক, বহু গবেষক এবং বনভোজন পার্টির আনাগোনায় ও ভিড়ে মহাস্থানগড় চঞ্চলতা ও আনন্দ উল্লাসে মুখরিত। দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের গরিমা সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে সেসব পুরাকীর্তির যথাযথ তত্ত্বাবধান খুবই প্রয়োজনীয়
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।